ঢাকাসোমবার , ১৩ নভেম্বর ২০২৩

তিস্তার চরে ৩৩ ধরনের ফসল, চর নিয়ে স্বপ্ন বুনছে কৃষক।

মোঃ আনোয়ার হোসেন
নভেম্বর ১৩, ২০২৩ ৬:১৪ অপরাহ্ণ
Link Copied!
   
                       

ডিমলা নীলফামারী প্রতিনিধি:

তিস্তার চর এখন খাদ্যের ডিপু। বিগত বছরের ন্যায় এবারও চলছে বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদ। সেইসঙ্গে বিভিন্ন গবাদিপশু লালন-পালন করা হচ্ছে

উত্তরের তিস্তা নদী নিয়ে জীবন চলার সুখ দুঃখের অনেক কাহিনি অতীত হয়ে গেছে ।
সেই দুঃখ কষ্টের চরে ফসল ফলিয়ে খাদ্যের জোগান দিয়ে নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে যাচ্ছেন চরের কৃষকরা। উত্তরাঞ্চলের তিস্তা সহ বিভিন্ন ছোট ছোট -নদীর চরগুলো হীরায় পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর এসব চরে ৩৩ প্রকার ফসল চাষাবাদ হচ্ছে। যা প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ হাজার কোটি টাকার ফসল উৎপাদন হয়ে থাকে। এ ছাড়া বছরে ২০ লাখ গবাদিপশুর জোগান দিচ্ছে চরে বসবাসকারীরা। রংপুর কৃষি অঞ্চল দপ্তরের তথ্যমতে, নীলফামারী, রংপুর, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলার তিস্তার নদীবেষ্টিত ১৫৪টি চরের জমির পরিমাণ সাড়ে ১৯ হাজার হেক্টর।
এর মধ্যে আবাদযোগ্য প্রায় ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে ৩৩ প্রকার ফসলের চাষাবাদ হচ্ছে। গত এক সপ্তাহ ধরে নদীর বিভিন্ন চরে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, কৃষক কৃষাণীদের ব্যস্তার কোন অন্ত নেই। চরে আলু, রসুন, মরিচ, পেঁয়াজ, ভুট্টা, গাজর, মিষ্টি কুমড়া,বিভিন্ন ধরনের শাক- সবজি সহ নানা ধরনের ফসলের জমি তৈরী ও পরিচর্যা চলছে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। পাশাপাশি প্রস্তুতি চলছে গম, ছোলা, মসুর, সরিষা ও বাদাম চাষের। চরের কৃষকরা জানায়, চরের জমিতে ৩৩ ধরনের ফসল চাষ করা হয়। বন্যার পর চরের মাটিতে পলি জমে। এ কারণে সার খুব একটা লাগে না। পোকামাকড়েরও আক্রমণ কম। কীটনাশকের ব্যয় তেমন নেই। তাই ফসল উৎপাদনে খরচও কম। চরাঞ্চলগুলোতে পণ্য পরিবহনের জন্য সাধারণত ঘোড়ার গাড়ি, ঠেলা গাড়ি, মহিষের গাড়ি, ব্যাটারিচালিত ভ্যান এবং বাইসাইকেল ব্যবহার করেন চাষিরা। প্রতি বছরের ন্যায় এ বছর তিস্তার বুকে অনেকটা বেশি অংশজুড়ে চর পড়েছে। যে কারণে চরাঞ্চলের কিছু কৃষক সেই চরের পলি পড়া জমিকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ফসল চাষ করছেন। আর ফলন হচ্ছে বাম্পার। তিস্তার কৃষকের ঘরে-ঘরে চলছে ফসলের বীজ বপনের প্রতিযোগীতা । বন্যা মৌসুমে তিস্তা চরাঞ্চলবাসীর আহাজারি, আর শুকনো মৌসুমে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ফসলের সমারোহ বলে দেয় তিস্তার রূপরেখা। কৃষকরা বলছেন, তিস্তা এখন চর নয়, চর এখন গ্রামে পরিণত হয়েছে।

চরখড়িবাড়ির কৃষক আঃ ছালাম (৫০) জানায় সে পাঁচ একর জমিতে ভুট্টা, পেঁয়াজ, আলু, মরিচ ও শাকসবজি চাষ করেছেন।তবে ফসল ঘরে তোলা আর বিক্রি নিয়ে আছে চরের কৃষকদের নানা অভিযোগ। চর কিসামতের কৃষক ও ইউপি সদস্য মকবুল হোসেন বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় কৃষকেরা উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বিশাল চর আর নদী পাড়ি দিয়ে ফসল নিয়ে যেতে হয় হাটে। ফলে উৎপাদন বেশি হলেও ব্যয়ও বৃদ্ধি পায় বহনে। ছাতুনামার গৃহবধূ পারভীন আক্তার পরি এই মৌসুমে ২৫ শতক জমিতে আবাদ করেছেন রসুন আর পেঁয়াজ, শাক-সবজি । তিনি বলেন, পরিবারের যতটুকু লাগে সেটা রেখে বাকিটা স্থানীয় বাজারে বেচে দিবেন। এতে সংসারে অর্থের জোগান হয়। কৃষক হাসেম আলী রসুন ও পেঁয়াজের পাশাপাশি সাথী ফসল হিসেবে বিভিন্ন ধরনের সবজির আবাদ করেছেন তিনি। চলতি মৌসুমে সতিরচরের সহিদুল ইসলাম তিনি দুই বিঘা জমিতে রসুন ও পেঁয়াজের পাশাপাশি এক একর জমিতে আলুও আবাদ করেছেন। কৃষক ছাবিনুর রহমান জানান, এক একর জমিতে আলু আবাদ করেছি। ফলন ভালো হলেও মূল সড়ক থেকে চর দূরে হবার কারণে পাইকাররা দাম কম করেন। সে কারণে অনেক সময় লোকসানেও পড়তে হয়। তবে বিশেষ করে ভুট্টা চাষে বেশ লাভবান হচ্ছেন তারা। প্রতি বিঘায় ৪০ থেকে ৪৫ মণ পর্যন্ত ভুট্টা হয়। যার মূল্য প্রায় ৩০ থেকে ৩২ হাজার টাকা। আর ব্যয় হয় বিঘাপ্রতি ১০-১২ হাজার টাকা।

বাইশপুকুর চরের কৃষক আমজাদ মিয়া বলেন, চরে মিষ্টি কুমড়া ভালো ফলন হয়। গত বছর চরের উৎপাদিত মিষ্টি কুমড়া বিদেশে রপ্তানি হয়েছে। এবারও মিষ্টি কুমড়া চাষের জন্য চরের জমি প্রস্তুত করে সেখানে বীজ বপন করা হচ্ছে। কৃষক আজিজুল ইসলাম (৪৫) উপজেলা কৃষি অফিস থেকে কুমড়া চাষের বীজ ও সার দেওয়া হয়। মহিপুর এলাকার উত্তর চরখড়িবাড়ী চরের কৃষক ছলেমান আলী বলেন, চরের সকল কৃষককে যদি সরকারিভাবে সার বীজ প্রণোদনা দেওয়া হতো তাহলে চরের সকল কৃষক উপকৃত হতো।

ডিমলা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সেকেন্দার আলী বলেন, আমরা চরের মানুষের জন্য কাজ করছি। কোনো চর যাতে করে পড়ে না থাকে সেদিকে লক্ষ্য করে কৃষকদের চাষাবাদের পরামর্শ দিচ্ছি। তিনি আরো জানায় কৃষি বিভাগের মাঠ পর্যায়ের নিয়মিত তদারকি ও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। ‘আমাদের মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তারা বাদেও আমি নিজেও প্রতিদিন মাঠে গিয়ে চরের কৃষকদের সঙ্গে কথা বলছি এবং বিভিন্ন রকমের পরামর্শ দিচ্ছি বলে তিনি যোগ করেন।’ অপরদিকে গত বছর তিস্তা নদীর বুকে জেগে ওঠা বালুচরে প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিকভাবে গাজর চাষের উদ্যোগ সফল হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রংপুর, গাইবান্ধা ও নীলফামারী জেলায় ৩০টি চরে এক হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে গাজর চাষ করা হয়। প্রতি হেক্টর জমি থেকে ৩০ মেট্রিক টন গাজর পাওয়া গেছে বলে জানা যায় । একতার বাজার চর এলাকার গাজরচাষি ইয়াকুব আলী জানান, গত বছরের মতো এবারও তিনি গাজর চাষের প্রস্তুতি নিয়েছেন। গত বছর তিনি আট একর চরের জমিতে গাজর চাষ করেন। ইয়াকুব আলী বলেন, ‘গাজর চাষে তার খরচ হয়েছে প্রায় ছয় লাখ টাকা। আট একর জমি থেকে তিনি এক লাখ ১০ হাজার কেজি গাজর পান। গাজর বিক্রি করেছেন ১২ লাখ টাকায়। এতে তার ছয় লাখ টাকা আয় হয়েছে।