ঢাকাশনিবার , ২১ জানুয়ারি ২০২৩

ফিরে দেখা ২০২২: পার্বত্য চট্টগ্রামের জানা-অজানা কিছু ঘটনা

তুষার তঞ্চঙ্গ্যা
জানুয়ারি ২১, ২০২৩ ৫:৩০ অপরাহ্ণ
Link Copied!
   
                       

তুষার তঞ্চঙ্গ্যা-(কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়):
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের তিনটি জেলা(বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি) নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম গঠিত। এখানে ১১টি আদিবাসী(সাংবিধানিক: উপজাতি, ক্ষুদ্র- নৃগোষ্ঠী) জনগোষ্ঠির বসবাস।এদের মধ্যে প্রধান তিনটি সম্প্রদায় হলো – চাকমা,মারমা এবং ত্রিপুরা। এছাড়াও রয়েছে তঞ্চঙ্গ্যা, লুসাই, পাংখো, মুরং, খিয়াং, বম, খুমি এবং চাক। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সমতল এলাকায় বসবাসকারী আদিবাসীদের জন্য এ বছরটি খুবই ঘটনাবহুল বছর বলা যেতে পারে। এই ২০২২ সালে বাংলাদেশের আদিবাসীদের সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা দেখে নেওয়া যাক :
২০ জানুয়ারী, ২০২২:-
নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়েছে এবং দেশের অসংখ্য শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য লাখ লাখ শিক্ষার্থীর সঙ্গে ভর্তি যুদ্ধে অংশ নিয়ে ইতোমধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী সম্প্রদায়ের শত শত শিক্ষার্থীও প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করে।কেউ কেউ মেধাতালিকা পেলেও বেশির ভাগ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে কোটার আবেদনের মাধ্যমে। কিন্তু উচ্চশিক্ষা নিতে এসে আদিবাসী ছাত্রদের উচ্চারণ এবং কোটায় ভর্তি হওয়া নিয়ে প্রায়ই সহপাঠী কিংবা অন্য শিক্ষার্থীদের দ্বারা হয়রানির শিকার হন।তাদের এমন আচরণে আদিবাসী ছাত্ররা অপমান, আত্মবিশ্বাসের অভাব এবং হতাশ হয়ে পড়েন তারা সেটা বোঝার চেষ্টাও করে না। পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে যারা জানেন তারা সেখানে বসবাসকারী মানুষের কথাও জানেন। আর যারা জানেন, তারা কখনোই সচেতনভাবে এমন আচরণ করেন না।
২২ ফেব্রুয়ারী, ২০২২:-
‘ইয়া্ংঙান ম্রো’ প্রত্যন্ত অন্ধকার পার্বত্য চট্টগ্রামে আলোর রশ্মির মতো তার রূপ। যেখানে জীবনের প্রতিটি ধাপে অস্তিত্ব ও পরিচয়ের ভয়ের মুখোমুখি হতে হয়, যেখানে দিনে দিনে খাওয়া একটি দুর্দান্ত বিলাসিতা, সেখানে ‘ইয়া্ংঙান ম্রো'(২৫) মনে হয় একটু বেশিই বিলাসি। কিন্তু, এই বিলাসিতা খাওয়া-দাওয়ার নয়, এই বিলাসিতা জ্ঞানের বিলাসিতা। পার্বত্য চট্টগ্রামের ম্রো সম্প্রদায়ের একজন লেখক ও গবেষক ‘ইয়া্ংঙান ম্রো’ সেই বিলাসের জন্য ইতিমধ্যে এক ডজনেরও বেশি বই প্রকাশ করেছেন। তিনি তার সম্প্রদায়ের পাশাপাশি সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিতে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁর মহান উদ্দেশ্য আলোর সূর্য হয়ে সারা পার্বত্য অঞ্চলে এবং সারা দেশে সেই আলো ছড়িয়ে পড়ুক, আমরা আশা করি।
৯ মে ২০২২:-
বান্দরবানের লামা উপজেলায় লাংকমপাড়া, রেংয়েনপাড়া ও জয়চন্দ্রপাড়ার জুমের বাগান পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের একটি কোম্পানির বিরুদ্ধে। আগুনে প্রায় সাড়ে তিনশ একর জুমের ধান, বাঁশ, আম, কলা, আনারসসহ বিভিন্ন ফলদ ও বনজ গাছ পুড়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়িরা এখন উচ্ছেদ আতঙ্কে ভুগছেন।অধিকাংশ পাড়াবাসী খাবার সংকটে ভুগছেন, আগুনে তাদের বাগান পুড়ে যাওয়ায় তাদের ঘরে খাবার নেই। তারা পানীয় জলের সঙ্কটেও আছেন। জঙ্গলের লতাপাতা সেদ্ধ করে খেয়ে না খেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।সারা দেশে প্রভাবশালী মহলের আশীর্বাদপুষ্ট একশ্রেণির সামাজিক অপরাধী, ছদ্মবেশী সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্ত এবং ভূমিদস্যু একের পর এক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর মানুষ, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং প্রান্তিক অবস্থানে থাকা অন্যান্য নারী-পুরুষদের উপর দিনের পর দিন, বছরের পর বছর যে নিপীড়ন, উচ্ছেদ, অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে এ ঘটনা তারই সাম্প্রতিক ধারাবাহিকতার সাক্ষ্য বহন করে।
২৩ মে ২০২২:-
আপনারা অনেকেই জানেন যে, রাঙ্গামাটির জুরাছড়ির সুরো কৃষ্ণ চাকমা দেশের প্রথম পেশাদার আন্তর্জাতিক বক্সিং টুর্নামেন্টের ৬১ তম লাইটওয়েট ইভেন্টে সেরা হয়েছেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মিরপুরের শহীদ সোহরাওয়ার্দী ইনডোর স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয় ‘সাউথ এশিয়ান প্রফেশনাল বক্সিং ফাইট নাইট- দ্য আল্টিমেট গ্লোরি’ টুর্নামেন্ট। সুরকৃষ্ণ চাকমা নেপালি বক্সার মহেন্দ্র বাহাদুর চাঁদকে পরাজিত করেন। সুরো কৃষ্ণ চাকমা বলেন, সবার সামনে নিজ দেশের পতাকা উত্তোলনের মধ্যে অন্যরকম ভালোলাগা আছে। কিন্তু কয়েকদিন আগেও বান্দরবানের লামায় রাবার বাগানের নামে স্থানীয় আদিবাসী পরিবারগুলোকে উচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্র করা হয়। খাবার ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদের উচ্ছেদের চেষ্টা করা হয়। শুধু তাই নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে কড়া নজর রাখলে কয়েকদিন পর পর এরকম অসংখ্য ঘটনার খবর পাবেন। তাদের মধ্যে কেউ যদি এই ধরনের বহু বাধা অতিক্রম করে বহু বছরের অনিশ্চয়তাপূর্ণ পরিবেশ থেকে উঠে এভাবেই দেশের পতাকা উত্তোলন করে, তবে সে তাদের দিকে আঙুল তুলতে দ্বিধা করবে না।
৬ সেপ্টেম্বর ২০২২:-
সম্প্রতি একটি কৃত্রিম হ্রদ খননের ঘোষণা দিয়েছে বন বিভাগ। এমনটাই ঘোষণা করেছে বন বিভাগ ।তাদের বুকে কোদাল চালান, উন্নয়নের নামে এসব জমি উচ্ছেদ ও উচ্ছেদের ষড়যন্ত্রে আদিবাসীরা কখনো নীরব থাকেনি। তাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে দেশের কিছু প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীও সেসব আন্দোলনে যোগ দেন।এসব উন্নয়নের নামে মধুপুরের শালবন এর আগে জমি উচ্ছেদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল। ‘পিরেন স্নালের’ মতো গারো নেতাকে জীবন দিতে হয়েছে।যুগে যুগে বসবাসকারী তাদের পূর্বপুরুষদের জমি, যার সাথে একটি গোষ্ঠী বা জাতির অনেক কিছু জড়িয়ে আছে। তাদের অস্তিত্ব তাদের মাটিতে, তাদের আত্মা মাটিতে মিশে আছে। শুধু গারোরা নয়, এই ধরনের মূল্যবান ভূমি যা কোনো সভ্য মেরুদণ্ডী মানুষ ছাড়তে চাইবে না। আমরা চাই সরকার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করুক এবং গারো আদিবাসীদের ঐতিহ্য রক্ষায় খনন প্রকল্প বাতিল করুক।
৭ সেপ্টেম্বর ২০২২:-
বান্দরবানের লামায় গ্র্যাবার রাবার কোম্পানির লোকজন খালের পানিতে বিষ ছিটিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে স্থানীয়রা। মূলত রাবার কোম্পানির লোকজন লাংকাম ম্রো পাড়া, জয়চন্দ্র ত্রিপুরা পাড়া এবং রেঙ্গেন ম্রো কারবারী পাড়ার ম্রো ও ত্রিপুরা আদিবাসী সম্প্রদায়ের জন্য পানির একমাত্র উৎসে বিষ প্রয়োগ করে। বাসিন্দাদের অভিযোগ, গ্রামবাসীদের বসতভিটা ছাড়তে বাধ্য কর ।

১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২:-
সাবিনা-সানজিদার পাশাপাশি, পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী মেয়েরা এবং সমতল এলাকার রূপনা চাকমা, মনিকা চাকমা, মারিয়া মান্ডা, ঋতুপর্ণা চাকমা, আনুচিং মোগিনী, কৃষ্ণা রানী সরকার নেপালের বিপক্ষে বাংলাদেশ মহিলা ফুটবল দলের আজকের সাফল্যের পিছনে নিজেরাই উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে। তারাও গর্বের সাথে সারা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বলভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। তবে ‘সংখ্যালঘু, উপজাতি’ ইত্যাদির নামে তাদের পরিচিত-স্বজনদের নিজেদের জমি ও পর্যটন থেকে উচ্ছেদ করে সেসব জায়গায় পাঁচ তারকা হোটেল গড়ে তোলা হচ্ছে। এমনকি কিছু লোক তাদের ‘বহিরাগত’ বলতেও দ্বিধা করে না।
১৮ অক্টোবর ২০২২:-
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই যুগে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের নিজস্ব জীবনধারা কেমন? অযাচিত ব্লগারদের বিরক্তিকর শাটল, পর্যটনের প্রসারের সাথে, বিপুল সংখ্যক পর্যটক এবং ব্লগার প্রতিদিন তাদের বাড়ির দোরগোড়ায় আসছেন এবং তাদের জীবনযাত্রা দেখতে নাক ডাকছেন। কিন্তু, পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা কি সত্যিই এমন পরিস্থিতিতে তাদের নিজস্ব জীবনধারা বজায় রাখতে সক্ষম হচ্ছে যেখানে তাদের গোপনীয়তা অবশিষ্ট নেই? রান্নাঘর থেকে বেডরুম পর্যন্ত তাদের জুমঘর এখন ক্রমাগত সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ট্রিম করছে। ফলে ইতিমধ্যেই তাদের পোশাকে আমূল পরিবর্তন এসেছে। তাদের মধ্যে পরিবর্তন এসেছে বিশ্বাসগুলিও। অন্যদের বিশ্বাস তারা এখন নিজের মধ্যে এবং অন্যান্য অনেক পরিবর্তন অনুভব করে। এক কথায় ভয়, সংশয়, দ্বিধা ও অনিশ্চয়তায় তাদের দিন কাটছে এখন।