ঢাকাশুক্রবার , ২৮ জুলাই ২০২৩

ইউক্যালিপটাস গাছ উৎপাদন, বিপণন ও রোপণ বন্ধের দাবিতে বেলা’র আয়োজনে মানববন্ধন

মাসুম বিল্লাহ
জুলাই ২৮, ২০২৩ ৮:০২ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!
   
                       

শেরপুর বগুড়া প্রতিনিধিঃ
২৭ জুলাই ২০২৩ তারিখে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)-এর আয়োজনে বগুড়ার শেরপুর উপজেলার খেজুরতলায় ‘প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ইউক্যালিপটাস গাছ উৎপাদন, বিপণন ও রোপণ বন্ধের দাবিতে’ এক মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন স্বপ্ন’র নির্বাহী পরিচালক মো. জিয়াউর রহমান, গাড়িদহ অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের সভাপতি মো. মোখছেদ আলী, সমাজ উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মো. আব্দুর রহিম, পরিবেশ প্রতিরক্ষা সংস্থার সভাপতি, সোহাগ রায় সাগর, উষা’র নির্বাহী পরিচালক এম ফজলুল হক বাবলু, স্বাধীন জীবন’র নির্বাহী পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক নাছিম প্রমূখ। মানববন্ধন সঞ্চালনা করেন বেলা’র রাজশাহী কার্যালয়ের সমন্বয়কারী তন্ময় কুমার সান্যাল। মানববন্ধনে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, এনজিও একটিভিস্টসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রায় শতাধিক মানুষ অংশগ্রহণ করেন।

মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন বা উষ্ণায়ন বৃদ্ধির পেছনে যে কয়েকটি কারণকে প্রত্যক্ষভাবে দায়ি করা হয়, বন ধ্বংস বা বন বিনাশ তারমধ্যে অন্যতম। সারা বিশ্বে বন ধবংস, জীববৈচিত্র্যের ক্ষয় এবং বাস্তুসংস্থান ধ্বংসের যে প্রক্রিয়া চলছে সেক্ষেত্রে বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। মূলত: বন ধ্বংসের বিকল্প হিসেবে সামাজিক বনায়নকে প্রাধান্য দিয়ে দেশে নানা কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৭০ সালের মাঝামাঝি সময়ে ইউক্যালিপটাসসহ বেশকিছু বিদেশী দ্রæত বর্ধনশীল গাছ আমাদের দেশে আসে। পরবর্তীতে উপজেলা পর্যায়ে ‘সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি’ এবং সরকারের বনবিভাগের বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে ১৯৮০ সালের মাঝামাঝি সময়ে ইউক্যালিপটাস ও অন্যান্য বিদেশী গাছ ব্যাপকভাবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে লাগানো হয়েছে। দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় প্রথম এই গাছের চারা বিনামূল্যে বিতরণ করা হয় এবং এভাবেই ইউক্যালিপটাসসহ কিছু বিদেশী গাছ ছড়িয়ে পড়ে দেশের সর্বত্র। যদিও বন রক্ষায় বা পুনরুদ্ধারে এ সকল প্রকল্প তেমন কার্যকরী নয় বরং সামাজিক বনায়নের নামে ভিন্ন ও বিদেশী প্রজাতির বৃক্ষ (ইউক্যালিপটাস, একাশিয়া ইত্যাদি) রোপণ বা চাষ প্রাকৃতিক বনায়ন রক্ষার পরিবর্তে ধবংস করছে।

বক্তারা বলেন, দ্রুত বর্ধনশীল এবং অভিযোজন ক্ষমতার কারণে ইউক্যালিপটাস অনেক দেশেই কাঠের গাছ হিসাবে জনপ্রিয়তা পেলেও এর রয়েছে নানা অভিযোগ ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া। এই গাছে অধিক পরিমাণে তেল থাকায় এটা বেশ দাহ্য এবং এর আবাসভূমি অস্ট্রেলিয়াতে একে অগ্নি সৃষ্টিকারী হিসাবে আখ্যা দেওয়া হয়। তাই সেখানে আবাসিক এলাকায় এবং ঘরবাড়ির কাছে এই গাছ কম লাগানো হয়। বিশে^র বিভিন্ন দেশে ইউক্যালিপটাসের ক্ষতিকর প্রভাব পরিলক্ষিত হওয়ায় সেখানকার কৃষিজমি, নদীর ধার ও নদী অববাহিকা ইত্যাদি স্থানে এ ধরনের বৃক্ষ রোপণ নিষিদ্ধ করা হয়। একটি গবেষণায় বলা হয়, দেশীয় প্রজাতি ও ইউক্যালিপটাসের বনায়ন পাশাপাশি করা হলে অনেক সময় জীববৈচিত্র্যে সুসমন্বয়ের অভাব দেখা দেয়, অথবা অনাকাংখিত অনেক প্রজাতি পুনরায় ফিরে আসে যা প্রাকৃতিক বনায়নের ক্ষেত্রে ব্যাঘাত ঘটায়।

বক্তারা আরও বলেন, আমাদের দেশেও ইউক্যালিপটাসের বাগান/বনায়নের ফলে সরাসরি বেশ কিছু প্রভাব পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের উপর পরিলক্ষিত হয়। যেমন- মাটি, পানি, জলবায়ু, পরিবেশ ও প্রতিবেশ, মানব স্বাস্থ্য, পশুপাখি ও কীটপতঙ্গের ওপর প্রভাব। এসব বিদেশী গাছ আমাদের দেশীয় প্রজাতি ধ্বংসের পাশাপাশি মাটির উর্বরতা নষ্ট, প্রাণির অভয়াশ্রম নষ্ট, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের ক্রমাবনতি, প্রাকৃতিক পরিবেশের বিপর্যয় ইত্যাদির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে ইউক্যালিপটাস গাছের সংখ্যা কত এবং এই গাছের প্রভাবে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের কোনো ক্ষতি হচ্ছে কিনা বা কি পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে তার কোনো পরিসংখ্যাণ এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার তথ্য বনবিভাগ বা পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে নেই। দেশে সবচেয়ে বেশি ইউক্যালিপটাস চোখে পড়ে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে। রাস্তার ধারে, আবাদী জমিতে, ধান ক্ষেতের আইলে, পুকুর পাড়ে এমনকি কারো কারো উঠানেও লাগানো হচ্ছে ইউক্যালিপটাস। সরকারি পর্যায়ে বিধি-নিষেধ থাকলেও বগুড়া, নওগাঁ, জয়পুরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, নীলফামারীসহ অনেক জেলার নার্সারীগুলোতে বাণিজ্যিকভাবে ইউক্যালিপটাসের চারা উৎপাদন এবং পরবর্তীতে তা রোপণ করা হচ্ছে। এমনকি বনবিভাগের সামাজিক বনায়ন কর্মসূচিতেও এই গাছ রোপণ করা হয়ে থাকে। নানা বির্তকের প্রেক্ষিতে সরকার বিভিন্ন সময়ে ইউক্যালিপটাস গাছ লাগানো বন্ধের পদক্ষেপ নিলেও শেষ পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেনি। সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্তে¡ও বিদেশী প্রজাতির ইউক্যালিপটাস উৎপাদন ও রোপণ কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। কোনো ভিনদেশী প্রজাতির অন্তর্ভূক্তি যদি আমাদের বাস্তসংস্থানের নিজস্বতাকে হুমকিতে ফেলে তাহলে তা পরিহার করাই মঙ্গল।

সুপারিশ:

· দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ইউক্যালিপটাসের চারা উৎপাদন, বিপণন এবং রোপণ নিষিদ্ধ করা;

· এই গাছের ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে গবেষণা করা;

· এই গাছের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা;

· কোনো বিদেশী প্রজাতির গাছ দেশে রোপণের আগে তার ক্ষতিকর দিকসমূহ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করা;

· গাছ, শস্য, প্রাণী বা অন্য কোনো বিদেশী প্রজাতি বাংলাদেশে পরিচিত করার ক্ষেত্রে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, পরিবেশ বিশেষজ্ঞ এবং পরিবেশ কর্মীদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া;

· ইউক্যালিপটাসের মতো প্রকৃতি ও পরিবেশ বিরোধী বিদেশী গাছের বিপরীতে দেশীয় প্রজাতির ফলদ গাছের আর্থিক ও আত্মিক লাভের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা।