ঢাকাবুধবার , ২৭ মার্চ ২০২৪

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ শহীদ অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যের প্রয়াণ দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা

উজ্জ্বল কুমার সরকার
মার্চ ২৭, ২০২৪ ১২:১৫ অপরাহ্ণ
Link Copied!
   
                       

উজ্জ্বল কুমার সরকারঃ

বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের ঊষালগ্নে হানাদার পাকিস্তানিদের হাতে নিহত স্বপ্নশৌর্যদীপ্ত তরুণ প্রাণ অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য। অত্যন্ত মেধাবী অনুদ্বৈপায়ন ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়ে জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন । ১৯৭১সনের ২৫শে মার্চে পাকিস্থানিদের পরিচালিত হত্যাযজ্ঞের রাতে অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য ছিলেন জগন্নাথ ছাত্রাবাসের আবাসিক শিক্ষক হিসেবে কর্তব্যরত।
ভয়াল সেই রাতে ছাত্রবাস অরক্ষিত রেখে তিনি পলায়নে উদ্যোগী ছিলেন না। রাতশেষের সকালে পাকিস্থানীরা তাঁকে খুন করে। শহীদ বুদ্ধিজীবী অভিধায় জাতীয় সম্মানে অভিষিক্ত অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য বাংলাদেশের জন্মস্মৃতির অংশ। ২৫শে মার্চ গভীর রাত, ঘড়ির কাঁটা অনুসারে ২৬ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কয়েকটি উপদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে অতর্কিতভাবে আক্রমণ চালায়। ঘাতক সেনারা অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্জিকে জগন্নাথ হলের অ্যাসেম্বলি ভবন থেকে আটকের পর পিঠমোড়া দিয়ে দুই হাত কষিয়ে বেঁধে ফেলে রাখে।
ভোরে রাইফেলের বাঁট দিয়ে মারতে মারতে অ্যাসেম্বলি হল সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের সাময়িক অধিবেশন কক্ষের কাছে দক্ষিণ বাড়ির নিকট নিয়ে যায় । সেখানে আরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা কর্মচারী ও ছাত্রদের সঙ্গে অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যকে গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায় অধ্যাপক অজয় রায়ের রচনায়।
তিনি লিখেছেন, ‘খুব সম্ভব ১৯শে মার্চ (৭১) তারিখে শহীদের সাথে আমার শেষ আলাপ হয়। … কলম্বো প্ল্যানের বৃত্তি নিয়ে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্জির যাবার প্রস্তুতি শেষ-তারিখ নির্ধারিত হয়েছিল ২৬ মার্চ রাতে। জানাল ঐ রাতে বাড়ি যাচ্ছে মাকে দেখতে, খুব সম্ভব ফিরে আসবে ২৪শে বা ২৫ শে মার্চ।‘সেই ভয়াল রাত্রে কখন কিভাবে, অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্জি শাহাদাৎ বরণ করেছিলেন, কোনো দিনই প্রকৃত তথ্য জানা যাবে না। তবে পরবর্তীকালে নানা তথ্য ও উৎস থেকে জানা গেছে যে, অনুদ্বৈপায়ন চট্টোপাধ্যায় ২৫ মার্চ সকালের দিকে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেছিল। ২৭ মার্চ কারফিউ উঠলে ছুটে গিয়েছিলাম জগন্নাথ হলে সহকর্মী ও ছাত্রদের অবস্থা দেখবার জন্য, যা দেখেছি বর্ণনার অতীত। … দেখা হয়েছিল সেখানে দক্ষিণ বাড়ির দারোয়ান মাখনের সাথে (এখন মৃত)। ক্রন্দনরুদ্ধ কণ্ঠে ও অনুদ্বৈপায়নের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জানাল: “স্যারকে ওরা পিছমোড়া করে দুহাত বেঁধে বন্দুকের বাঁট দিয়ে মারতে মারতে টেনে নিয়ে যায় অ্যাসেম্বলি ভবনের দিক থেকে।

তারপর দক্ষিণ বাড়ির সামনে আরও ২/১ জনের সাথে গুলি করে মারে।”মাখন এ ঘটনা দক্ষিণ বাড়ির কাছে ওর ঘর থেকে লুকিয়ে দেখে ২৬শে মার্চ প্রত্যুষে।’ অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্জি ২৫ মার্চে সিলেট থেকে ফিরে রাতে গিয়েছিলেন অধ্যাপক জালালুর রহমানের পলাশীর মোড়ের বাসায়। তিনি তাঁকে তাঁর বাসায় থাকার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু অত রাতে শিক্ষককে বিব্রত করতে চাননি তিনি। অবিবাহিত অনুদ্বৈপায়ন জগন্নাথ হলের হাউস টিউটর হিসেবে অ্যাসেম্বলি হলের পাঠাগারসংলগ্ন দুটি কক্ষে থাকতেন। অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যের মরদেহের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয়, গণকবরে তাঁকে মাটিচাপা দেওয়া হয়। ১৯৪৫ সালের ৩১ জানুয়ারি সিলেটের নবীগঞ্জ থানার জান্তারী গ্রামে অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্জির জন্ম। বাবা দিগেন্দ্র ভট্টাচার্জি। অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ১৯৬১ সালে নবীগঞ্জ জে কে হাইস্কুল থেকে অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এর পর সিলেট এমসি কলেজ থেকেও মেধা তালিকায় আইএসসি পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে বিএসসি, অনার্স পাস করে ফলিত পদার্থবিজ্ঞানে এমএসসি ডিগ্রি নেন। এমএসসি পাশের পড়ে ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত পদার্থবিদ্যা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে তিনি জগন্নাথ হলের হাউস টিউটর নিযুক্ত হন।
অধ্যাপক অজয় রায়, আলী জাফর, জালালুর রহমান, হিরণ্ময় সেনগুপ্ত ও জগদীশ শুক্ল দাস প্রমুখ ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তাঁর সরাসরি শিক্ষক। তাঁরা সবাই একবাক্যে বলেছেন অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যের মতো মেধাবী, নিষ্ঠাবান, বিনয়ী ছাত্র এবং পরবর্তীকালে সহকর্মী হিসেবে পাওয়া একটি দুর্লভ ব্যাপার। স্বাধীনতার পর জগন্নাথ হলের অ্যাসেম্বলি হলের নামকরণ করা হয় ‘অনুদ্বৈপায়ন ভবন’। পরে জগন্নাথ হলের এই পুরানো ভবন একটা সময় ভেঙে পড়ে। অনুদ্বৈপায়ন ভবনে অক্টোবরে চাপা পড়ে নিহত হয় অনেক ছাত্র। পরে সেখানে নির্মিত নতুন ভবনের নামকরণ করা হয়েছে চাপা পড়ে নিহত ছাত্রদের স্মরণে ‘অক্টোবর ভবন’। ১৯৯৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে বাংলাদেশ সরকারের ডাকবিভাগ শহীদ বুদ্ধিজীবী অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যের নামে স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে। তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল পাঠাগারের নামকরণ হয়েছে ‘শহীদ অনুদ্বৈপায়ন পাঠাগার’।